পশ্চিমবঙ্গ দিবস কি ও কেন? সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
পশ্চিমবঙ্গ শুধুমাত্র কোন প্রদেশের নাম নয়। এটি বাঙ্গালী জাতির শেষ নিজস্ব বাসস্থান যেখানে তারা নিজের মত নিজের ধর্ম-ঐতিহ্য সংস্কৃতি-লোকাচার কে প্রাণভরে লালন-পালন করতে পারে।
কেন আজ পালন করা হয় পশ্চিমবঙ্গ দিবস? কি তাৎপর্য? আসুন জেনে নিই....
1940 সাল,মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে পাঞ্জাব,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু প্রদেশ,বালুচিস্তান ও কাশ্মীর কে নিয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এবং বাঙ্গালা ও অসম কে নিয়ে পূর্ব ভারতে দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব আনেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক। এই বছরই বাঙ্গালায় মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টির জোট সরকার মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের মাধ্যমে শিক্ষালাভ এবং শিক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে মুসলিম সংরক্ষণের প্রস্তাব আনেন। শুরু হয় বাঙ্গালায় আরবীকরন। প্রতিবাদে সরব হন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার অনুপ্রেরণায় আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও শ্যামাপ্রসাদ মাধ্যমিক শিক্ষা বিলের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
মুসলিম লীগ বাঙ্গালা সমেত পাকিস্তানের দাবিতে আন্দোলন আরো জোরদার করে। এরপর আসে 1946 এর নির্বাচন। এই নির্বাচনের সরাসরি পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্য নিয়েই নির্বাচনে অবতীর্ণ হয় মুসলিম লীগ। এবং ফল ও মেলে। মুসলিম ভোটের 82 শতাংশ পেয়ে মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত 119 টির মধ্যে 112 টি আসনে জয়লাভ করে মুসলিম লীগের প্রার্থী। এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা সরকার গঠন করে।
যার ফলাফল মিলেছিল কলকাতা দাঙ্গা এবং নোয়াখালী গণহত্যা তে। এই সময় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছিলো কলকাতাসহ সমস্ত বাঙ্গালা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু মুসলিম লীগের পাকিস্তানের স্বপ্ন বিনাশ করতে মাঠে নেমে পড়েছিলেন বাঙ্গালীর ত্রাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। 1941 এ ভারত সেবাশ্রম সংঘের প্রধান স্বামী প্রণবানন্দজী শ্যামাপ্রসাদ কে ভবিষ্যতে বাঙ্গালীর ত্রাতা হিসেবে উল্লেখ করে তাকে বাঙালি হিন্দুদের বাঁচানোর দায়িত্ব দিয়ে যান।
এই সময় বি আর আম্বেদকর তাঁর বই পাকিস্তান অর দি পার্টিশন অফ ইন্ডিয়া বইতে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে হিন্দু যেই বর্ণের হোক না কেন, মুসলিম রাষ্ট্রে তার জীবন অন্ধকারময়। এই বক্তব্য যে পরবর্তীকালে বাঙালি নিম্নবর্ণ হিন্দুদের কত সাহায্য করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শেষ পর্যন্ত আস্তে আস্তে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত হিন্দু রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে আসেন বাঙ্গালার পাকিস্তান যোগ আটকাতে।1946 সালের শেষদিকে বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, কৃষক নেতা হেমেন্দ্রকুমার সরকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রমূখ বাঙালি হিন্দু নেতা পাকিস্তান ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের উদ্দেশ্যে বেঙ্গল পার্টিশন লীগ গঠন করেন।
15 ই মার্চ, 1947:- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কলকাতায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাঙ্গালী হিন্দুর একটি স্বভূমির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার শ্যামাপ্রসাদের বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন জানায়।
29 শে মার্চ, 1947:- ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের সম্মেলনে বাঙ্গালা ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ গঠন এর পক্ষে মত দেন বর্ধমানের মহারাজ এবং কাশিমবাজারের মহারাজের সহ দেশীয় জমিদার বর্গ। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে নির্মল চন্দ্র চ্যাটার্জি বলেন "বাঙ্গালা ভাগ হিন্দু বাঙ্গালীর জীবন মরণের প্রশ্ন"। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা পশ্চিমবঙ্গ গঠন বাঙ্গালীর ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার একমাত্র পথ বলে উল্লেখ করেন।
4ঠা এপ্রিল,1947 :- বঙ্গীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ডঃ বিধান চন্দ্র রায়, ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী, ড: প্রমথ নাথ ব্যানার্জি, কুমার দেবেন্দ্রলাল খান সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ শ্যামাপ্রসাদ এর উপস্থিতিতে বাঙ্গালা ভাগ করে ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
23 শে এপ্রিল,1947 :- অমৃতবাজার পত্রিকার নেওয়া 5 লক্ষাধিক এর বেশি মানুষের Gallup Vote এ 98% মানুষ বাঙ্গালা ভাগ করে ভারতের মধ্যে হিন্দু বাঙালির আলাদা স্বভূমির পক্ষে রায় দেয়।
20শে এপ্রিল শ্যামাপ্রসাদ এর ডাকে কলকাতায় পরিবহন ধর্মঘট হয়। পার্টিকে তোয়াক্কা না করে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রিত ট্রাম শ্রমিক সংগঠন সর্বাত্মকভাবে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে।
7 ই মে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বাঙ্গালী হিন্দুর সুরক্ষার প্রয়োজনে বাঙ্গালা ভাগ করে পৃথক আবাসভূমির দাবিতে সোচ্চার হয়।
11 ই মে একটি বিবৃতি জারি করে বাঙ্গালার প্রাক্তন তপশিলি মন্ত্রী প্রেমহরি বর্মন জানান উত্তরবঙ্গের তপশিলি রা পশ্চিমবঙ্গ গঠনের এবং পশ্চিমবঙ্গে যোগ দেওয়ার পক্ষে।
পশ্চিমবঙ্গ আন্দোলন গণআন্দোলন পরিবর্তিত হয়েছে দেখে এবং বাঙ্গালাকে নিয়ে পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে দেখে কলকাতা দাঙ্গার দায়ী সুহরাবর্দী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ প্রমাদ গুনলেন, এবং যখন দেখলেন বাঙ্গালার পশ্চিমাংশ ভারতে ঢোকার মনস্থ করেছে তখন তারা অখন্ড বাঙ্গালী জাতির ধুয়ো তুলে স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব রাখলেন। প্রস্তাবিত অখন্ড বাঙ্গালার ইসলামীকরণের সমূহ সম্ভাবনা দেখে জিন্না এই প্রস্তাবটি পূর্ণ সমর্থন করেন। কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন দ্বিধাগ্রস্থ ছিল সম্পূর্ণ বাঙ্গালা পাকিস্তানকে দিয়ে দেবে না পশ্চিমাংশ ভারতভুক্ত করবে। কিন্তু বাঙ্গালার কিছু কংগ্রেস নেতা যেমন শরৎ বসু জিন্নাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে স্বাধীন যুক্তবঙ্গের প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন।
কলকাতা দাঙ্গা ও নোয়াখালী গনহত্যা র উদাহরণ দেখিয়ে স্বাধীন যুক্তবঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ করলেন শ্যামাপ্রসাদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এবং স্বাধীন যুক্তবঙ্গে যে বাঙ্গালী হিন্দুর স্বার্থ রক্ষা হবে না তা তারা আগেই বুঝেছিলেন । স্বাধীন যুক্তবঙ্গ হলে হিন্দুদের কি অবস্থা হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসা ও বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান হিন্দু জনসংখ্যা দেখে। তিনি বললেন যেহেতু স্বাধীন যুক্তবঙ্গের ক্ষমতায় লীগ নেতারাই থাকবেন তাই বাঙ্গালী হিন্দুর স্বার্থ রক্ষা হবে না। তাই ভারতভুক্তি ই ভালো।স্বাধীন যুক্তবঙ্গ কে তিনি উপ-পাকিস্তান বলে অভিহিত করেছিলেন।
3রা জুন মাউন্টব্যাটেন ভারত ভাগের প্রস্তাবনা আনেন। ঠিক হয় পাঞ্জাব ও বাঙ্গালার আইনসভায় ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক করবে তারা ভারত নাকি পাকিস্তান এ যোগ দেবে।
18 ই জুন কলকাতায় মতুয়া মহাসঙ্ঘের নেতা ও গণপরিষদ সদস্য প্রমথরঞ্জন ঠাকুর পশ্চিমবঙ্গে যোগ দেওয়ার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
বাঙ্গালার প্রাদেশিক আইনসভাযর বিধায়কের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। এবং 126-90 ভোটে বাঙ্গালা ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রত্যুত্তরে 20শে জুন বাঙ্গালার পশ্চিম অঞ্চলের বিধায়করা 58-21 ভোটে পশ্চিমবঙ্গ কে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের একটি প্রদেশে হিসাবে সংযুক্তিকরণ নিশ্চিত করেন।
অর্থাৎ আজকের দিনেই পশ্চিমবঙ্গের বিধায়করা পাকিস্তান ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গ ছিনিয়ে নিয়ে ভারতে অন্তর্ভুক্ত করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সগর্বে জহরলাল নেহেরু কে বলেন "তুমি ভারত ভাগ করেছ, আমি পাকিস্তান ভাগ করলাম।"
আজ সেই পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিন বা পশ্চিমবঙ্গ গঠন দিবস।
এই পশ্চিমবঙ্গ কে আমাদের পূর্বপুরুষরা বহু কষ্টে লাভ করেছিল।
আজ আমাদের বাঙ্গালীদের আপন ভিটেমাটি এর জন্মদিনে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাই এবং যেসব মনীষীরা এবং যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা পশ্চিমবঙ্গের ভারতভুক্তি করেছিল তাদের প্রণাম জানাই।
জয় বঙ্গ জয় ভারত।
~~ অরিজিৎ
#westbenagalday #পশ্চিমবঙ্গ_দিবস #fatherofwestbengal #repost
0 Comments